তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। গত রোববার দিবাগত মধ্যরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত চলা ভাঙচুর অগ্নিসংযোগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সাভারের সিটি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ও এর আশপাশের এলাকা। এ সময় স্থাপনা ও গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর চালানো হয়। দেওয়া হয় আগুন। এতে আহত হন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। তবে এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো প্রকার সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের হামলায় কমপক্ষে ২০-২৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান। গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সিটি ইউনিভার্সিটির কনফারেন্স কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান তিনি। উপাচার্য বলেন, সিটি ইউনিভার্সিটিতে হামলা করতে আসা ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ৫-৬ জন শিক্ষার্থীকে সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা আটকে রেখেছিল। তারা অসুস্থ হওয়ায় পরে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আরও ১১ জনকে আটকে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবি, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য স্বশরীরে এখানে এসে ক্ষতি সরজমিনে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং তার কাছেই ১১ জনকে হস্তান্তর করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গত রোববার রাতে থুতু ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ড্যাফোডিল ও সিটি ইউনিভার্সিটির দুজন শিক্ষার্থীর মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। বিষয়টি রাত ১০টার দিকে সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু রাত ১০টার পর থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত ড্যাফোডিলের অসংখ্য দুষ্কৃতকারী শিক্ষার্থী সিটি ইউনিভার্সিটিতে হামলা চালায়। তারা ইউনিভার্সিটির প্রধান ফটক ভাঙচুর করে। সীমানা প্রাচীর ভাঙচুর করেছে। এ ছাড়া ১৩টির মতো গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। হামলাকারী শিক্ষার্থীরা পরিকল্পিতভাবে আমাদের অফিস রুমে প্রবেশ করে ভিসি, প্রোভিসি, রেজিস্ট্রারের কক্ষসহ অফিসের সব কম্পিউটার ভাঙচুর করে। গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লুট করেছে। রাত সাড়ে ৪টার দিকে ক্যাম্পাসে এসে হতভম্ব হয়ে যাই। শিক্ষার্থীদের দ্বারা এমন কাজ কীভাবে সম্ভব। এরপর ড্যাফোডিলের উপাচার্যকে বিষয়টি জানিয়ে একজন প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ করা হয়। প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, পুলিশ প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হলেও তারা কোনো সহযোগিতা করেনি। হামলায় আমাদের ২৫-২৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আরও প্রায় শতাধিক আহত হয়েছেন। হামলাকারীরা শিক্ষার্থীসুলভ আচরণ করেনি। যাদের ধরা হয়েছে তারা যখন ভাঙচুর চালাচ্ছিল তখন তাদের ধরা হয়েছে। তারা শুধু শিক্ষার্থী নয় শিক্ষার্থী কি ল্যাপটপ, কম্পিউটার, এসি এগুলো চুরি করতে পারে? আমরা চাই ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করতে। সমাধান নাহলে আইনের আশ্রয় নেবো। ২০-২৫ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। ইউজিসি থেকে প্রতিনিধি দল আসছে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্য। তিনি জানান, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সোমবারের জন্য সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সিন্ডিকেট সভার পরে ক্লাস-পরীক্ষার বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এদিকে, গতকাল সোমবার সকালে সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে প্রবেশের ফটকেই দেখা যায় আগুনে পোড়ার দৃশ্য। বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাঁচ, কাঠসহ ভাঙা বিভিন্ন জিনিসপত্র। ভেঙে দেওয়া হয়েছে একটি প্রাইভেটকার, দুটি মাইক্রোবাস, দুটি মোটরসাইকেল। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে অন্তত তিনটি বাস, পাঁচটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকারে। এর মধ্যে কোনোটিতে সকালেও ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। অ্যাকাডেমিক ভবনেও চালানো হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। পুরো ভবনের জানালার থাই গ্লাস ভাঙা দেখা যায়, কোনোটি সম্পূর্ণ ভাঙা হয়েছে, কোনোটি আংশিক ভাঙা হয়েছে। ভেতরে ঢুকে প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় ফাইলের কাগজপত্র, ভাঙা কাচ ও ভাঙা আসবাবপত্র। সেখানে প্রায় প্রতিটি কক্ষের চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার, বাথরুমের কমোড, বেসিন, দরজা, এসি, ফটোকপি মেশিন, প্রিন্টার, অফিসকক্ষ, অভ্যর্থনাকক্ষ ও কর্মকর্তাদের ডেস্কগুলো সম্পূর্ণ ভাঙচুর করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চালানো হয়েছে ব্যাপক লুটপাট। ল্যাপটপ, টাকাসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানান, গত রোববার সন্ধ্যার পর ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ভাড়া বাসা ‘ব্যাচেলর প্যারাডাইস হোস্টেল’ পাশে বসে ছিল সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্য এক শিক্ষার্থী থুথু ফেললে অসতর্কতাবশত সেখান দিয়ে মোটরসাইকেলে যাওয়া ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীর শরীরে লাগে। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরে রাত ৯টার দিকে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী দেশি অস্ত্র ও ইট-পাটকেল নিয়ে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের ভাড়া করা ওই বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে জড়ো হন। একপর্যায়ে তারা সিটি ইউনিভার্সিটির দিকে অগ্রসর হন। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হন। তারা সিটি ইউনিভার্সিটির প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। এরই মধ্যে সিটি ইউনিভার্সিটি সংলগ্ন এলাকায় পৃথক একটি স্থানে সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ড্যাফোডিলের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন। পরে ড্যফোডিলের শিক্ষার্থীরা সিটি ইউভার্সিটি ক্যাম্পাসে ঢোকেন। এ সময় ক্যাম্পাসে দাঁড় করিয়ে রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বাস, দুটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকারে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। একটি বাস, দুটি প্রাইভেটকার, একটি মোটরসাইকেল, প্রশাসনিক ভবন ভাঙচুর করা হয়। পরে ভাঙচুর শেষে ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা সিটি ইউনিভার্সিটি এলাকা ত্যাগ করে। এ সময় উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ওই এলাকায় ছিলেন। সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বলেন, ড্যাফোডিলের এক ছাত্রের গায়ে থুথু লাগা থেকে ঘটনার শুরু। পরবর্তী সময়ে সে স্যরিও বলেছে। কিন্তু তারা বিষয়টিকে সেভাবে নেয়নি, তাকে সেখানে মারধর করে। এরপর তাকে আটকে রাখে। যখন বিষয়টা আমাদের কাছে এসেছে, তখন আমরা এগোই। এভাবেই শুরু হয়। আমরা ঢিল ছুড়ছি, এমন পর্যন্তই ছিল। কিন্তু পরে তারা, আমাদের ভেতরে গেলে দেখবেন, অ্যাকাউন্টসে কোনো টাকা নেই, পাঁচটি গাড়ি ভেঙেছে। প্রত্যেকটা রুমে রুমে সব ভাঙছে। কিছুই নেই। এগুলো কী ধরনের আচরণ। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কীভাবে পারে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ঘুমন্ত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তারা অস্ত্র নিয়ে আসে। মেয়েদের হলের কলাপসিবল গেটে ভাঙচুরের চেষ্টা করে, ইট ছুড়ে মারে। সেগুলো মেয়েদের গায়ে লেগেছে। আমাদের পুরো ক্যাম্পাস ভাঙচুর করেছে। সিটি ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, রাত ১২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রশাসনের অনেক সহযোগিতা চেয়েছি আমরা। ওরা এসে পুরো ক্যাম্পাসে আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। শত শত ছাত্রকে মেরেছে, আহত করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাইনি। তারা খাগান পর্যন্ত এসেছে। ড্যাফোডিলের ছেলেরা এখানে এসে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল। কেউ রক্ষা করতে আসেনি। টানা হামলা হয়েছে, কিন্তু কেউ আসেনি। হাজার হাজার ছাত্র এখানে, আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। দুটি ছাত্রী হল আছে, তারাও আতঙ্কে আছে। আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতায় আছি। সিটি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর অধ্যাপক আবু জায়েদ বলেন, ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল সেটি এখনও আমরা নিশ্চিত নই। ছাত্রদের মারামারি থেকে ক্যাম্পাস পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা হতে পারে? এটি পরিকল্পিত। আমাদের শিক্ষার্থী আহতের সংখ্যা আনুমানিক অর্ধশতাধিক হতে পারে। এদিকে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, অসর্তকতাবশতই সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ফেলা থুথু ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীর শরীরে লাগে। সেখানে স্যরি বলে বিষয়টি সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু রাতে এসে ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীদের মেসে ভাংচুরের ঘটনাটি কাম্য নয়। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদেরই সন্তান আমাদের শিক্ষার্থী। আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি সমাধানের। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রক্টর শেখ মুহাম্মদ আলিয়ার বলেন, এখনও আমাদের ৯ জন শিক্ষার্থীকে সিটি ইউনিভার্সিটিতে আটকে রাখা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি সমাধানের। এ ঘটনায় ড্যাফোডিলের প্রায় দেড়শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম আ্যান্ড অপস.) মো. আরাফাতুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে রয়েছে। ঝগড়াবিবাদ, ভাঙচুর যা হয়েছে রাতেই হয়ে গেছে। আর এ ঘটনা কেনো ঘটলো, সেটি আসলে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে পরিবেশ কিছুটা থমথমে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
ড্যাফোডিলের সঙ্গে রাতভর সংঘর্ষ, সিটি ইউনিভার্সিটিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ
- আপলোড সময় : ২৮-১০-২০২৫ ০৭:৫৪:৩১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৮-১০-২০২৫ ০৭:৫৪:৩১ অপরাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
স্টাফ রিপোর্টার